SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

                                         গাহি সাম্যের গান -

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,

সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।

                                     ‘পূজারী, দুয়ার খোলো,

ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!”

স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,

দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !

জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ—

ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনি তো সাত দিন!”

সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারি ফিরিয়া চলে,

তিমিররাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে !

                                       ভুখারি ফুকারি' কয়,

‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!

মসজিদে কাল শিরনি আছিল, – অঢেল গোস্ত রুটি

বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি,

এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন

বলে, “বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'

তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-'ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,

ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নমাজ পড়িস বেটা?”

ভুখারি কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল-'তা হলে শালা

সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা ।

                     ভুখারি ফিরিয়া চলে,

                    চলিতে চলিতে বলে-

‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,

আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি প্রভু ।

তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি।

মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি !”

কোথা চেঙ্গিস, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?

ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার !

খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?

সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!

                   হায় রে ভজনালয়,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয় !
২০২১

Content added By

কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সনে (২৪শে মে ১৮৯৯ সালে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাঁকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয় । তাঁর অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্ৰদান করে। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস । যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ । ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়
সমাহিত করা হয় ।

Content added By

 সাম্য- সমতা। মহীয়ান— অতি মহান, ঠাকুর – দেবতা। ক্ষুধার ঠাকুর - ক্ষুধার্ত মানুষকে দেবতাজ্ঞান করা হয়েছে। যেমন ‘অতিথি নারায়ণ’। বর – আশীর্বাদ। কারো কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত বস্তু বা বিষয়। পান্থ – পথিক। ভুখারি – ক্ষুধার্ত ব্যক্তি। ক্ষুধার মানিক জ্বলে - ক্ষুধার্ত ব্যক্তির - জঠরজ্বালা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ফুকারি – চিৎকার করে। আজারি - রুগ্‌ণ, ব্যথিত। তেরিয়া - উদ্ধতভাবে, উগ্রভাবে, ক্রুদ্ধভাবে। গো-ভাগাড় – মৃত গরু ফেলার নির্দিষ্ট স্থান। পুরুত – পুরোহিত, পূজার্চনা পরিচালনার মুখ্য ব্যক্তি। চেঙ্গিস - চেঙ্গিস খান। গজনি মামুদ – গজনির সুলতান মাহমুদ তিনি সতের বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে ধ্বংসলীলা চালান। এখানে তাঁকে উপাসনালয়ের ভণ্ড দুয়ারীদের ধ্বংস করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। কালাপাহাড় - প্রকৃত নাম রাজচন্দ্র বা রাজকৃষ্ণ বা রাজনারায়ণ, কারো কারো মতে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি অনেক দেবালয় ধ্বংস করেছেন। যারা পবিত্র উপাসনালয়ের দরোজা বন্ধ করে, তাদের ধ্বংসের জন্য কবিতায় কালাপাহাড়কে আহ্বান জানানো হয়েছে।
 

Content added By

কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কাব্য থেকে মানুষ কবিতাটি সম্পাদনা করে সংকলিত হয়েছে। পৃথিবীতে নানা বর্ণ, ধর্ম, গোত্র আছে। বিভিন্ন ধর্মের জন্য পৃথক পৃথক ধর্মগ্রন্থও আছে। মানুষ ধর্মগ্রন্থগুলোকে খুবই শ্রদ্ধা করে, ধর্মের জন্য জীবনবাজিও রাখে। কিন্তু নিরন্ন অসহায়কে অনেক সময় তারা সামর্থ্য থাকার পরও অন্ন দান করে না । মন্দিরের পুরোহিত বা মসজিদের মোল্লা সাহেবরাও অনেক সময় এ রকম হৃদয়হীন কাজ করেন। মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু যে হতে পারে না, ধর্মও সে কথাই বলে । অথচ ধর্মকে ব্যবহার করে অনেকে স্বার্থ হাসিল করে এবং মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা করে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কবিতায় সে ভাবটিই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
 

Content added || updated By
Promotion
Content for the offcanvas goes here. You can place just about any Bootstrap component or custom elements here.